বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এখন যে কেউ কোনো প্রকার ভয় ছাড়াই তাদের মতামত, সমালোচনা এমনকি ব্যক্তিগত অপছন্দও প্রকাশ করতে পারছেন এবং এ জন্য কাউকে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।
শুক্রবার (২ মে) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত ‘জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন।
শফিকুল আলম বলেন, “আমরা কোনো সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করিনি বা কোনো ছাপাখানায় তালা লাগাইনি। বরং অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান উপদেষ্টার মাধ্যমে সম্পাদকদের ডেকে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, আপনারা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে আপনাদের মতামত তুলে ধরুন।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, যদি কোনো গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মীদের অন্যায়ভাবে ছাঁটাই করে, তবে সেই প্রতিষ্ঠানের সামনে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানোর অধিকার সকলের আছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভিডিওর মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রেস সচিব বলেন, আজকাল মানুষ মুদ্রিত খবরের চেয়ে ভিডিওর দিকে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি অসাধু চক্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে। তিনি একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ টেনে আনেন যেখানে একটি ভিডিওকে জামায়াত কর্মীদের দ্বারা একটি ছেলেকে হত্যার দৃশ্য বলে চালানো হয়েছিল, কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায় সেটি লাতিন আমেরিকার মাদক সংক্রান্ত একটি ঘটনা। এই ধরনের ভুল তথ্য সমাজে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাতের জন্ম দিচ্ছে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গণমাধ্যমকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান শফিকুল আলম। তিনি মনে করেন, এই দায়িত্ব কেবল সরকারের একার নয়, প্রতিটি সংবাদ সংস্থায় একটি নিজস্ব ফ্যাক্ট চেকিং বিভাগ থাকা অত্যাবশ্যক।
জাতিসংঘের ‘জুলাই গণহত্যা’ বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে প্রেস সচিব জানান, সেখানে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রীদের ভূমিকা বিস্তারিতভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তিনি গত ১৫ বছরের সাংবাদিকতার একটি সামগ্রিক চিত্র তৈরির জন্য জাতিসংঘের কাছে সহায়তা চেয়ে একটি প্রস্তাব লিখবেন। তার প্রস্তাবনায় থাকবে, একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন, আইসিটি মামলার রায় পরবর্তী সহিংসতা, মাওলানা সাঈদীর মামলার রায়ের পর দেশব্যাপী সৃষ্ট পরিস্থিতি এবং শাপলা চত্বর ট্র্যাজেডির মতো বড় ঘটনাগুলোতে গণমাধ্যমের ভূমিকা ও সাংবাদিকদের কাজের ধরন অনুসন্ধান করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য জাতিসংঘকে অনুরোধ করা হবে।
আলোচনা সভায় জুলাই আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের কয়েকজন সাংবাদিক কর্তৃক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ বারবার উঠে আসে। এই গুরুতর অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রেস সচিব বলেন, সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং প্রেস ক্লাবের উচিত একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে এই ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটন করা এবং দোষীদের আইনের আওতায় আনা।
অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, বিগত সরকার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করেছিল। এই আইন মূলত কিছু বিশেষ গোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণয়ন করা হলেও, পূর্ববর্তী সরকার সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবে এটি ব্যবহার করেছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং এই আইন শীঘ্রই বাতিল করা হবে।
তিনি আরও জানান, সরকার গণমাধ্যমে যেকোনো প্রকার প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপ বন্ধে একটি গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এবং কমিশন ইতোমধ্যে তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে। সরকার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে, যা দেশের গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের আরও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সদস্যসচিব জাহিদুল করিম কচির সভাপতিত্বে এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিএমইউজে) সেক্রেটারি সালেহ নোমান ও গোলাম মাওলা মুরাদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, সিএমইউজের সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নসরুল কদির ও বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. খুরশীদ জামিল।