চলমান বিক্ষোভের মুখে অবশেষে সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ শনিবার (১০ মে) রাতে অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে দলটির সকল প্রকার কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে।
গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগের বিচার ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে গত দুই দিন ধরে ছাত্র-জনতা ও বিভিন্ন দল-সংগঠনের বিক্ষোভ চলছিল। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে একই আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, উপদেষ্টা পরিষদে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদন। এই সংশোধনী অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।
আসিফ নজরুল আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে।”
এছাড়াও, আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে প্রকাশের সিদ্ধান্তও বৈঠকে গৃহীত হয়েছে বলে জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য এবং সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, গত বুধবার সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দেশ ত্যাগ করার পর বৃহস্পতিবার রাত থেকে আওয়ামী লীগের বিচার ও রাষ্ট্রদ্রোহী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধের দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতা রাজপথে বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের তিন দফা দাবির মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। ইসলামী ছাত্রশিবির, ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ), হেফাজতে ইসলাম এবং জুলাই মঞ্চের নেতা-কর্মীরাও এই বিক্ষোভে অংশ নেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে জানায় যে সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়। বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় এবং সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানানো হয়।
তবে, ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ব্যানারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতা তাদের বিক্ষোভ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। এই পরিস্থিতিতে শনিবার রাত ৮টায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের আগে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ হুঁশিয়ারি দেন যে এক ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ঘোষণা না এলে তারা আবারও ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি পালন করবেন। ঘোষণা না আসায় রাত ৯টার কিছু আগে আন্দোলনকারীরা যমুনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করলে পুলিশ তাদের ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে আটকে দেয়। তখনও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক চলছিল। রাত সাড়ে ৮টার মধ্যে সিদ্ধান্ত আসার কথা থাকলেও বৈঠক চলে রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত। অবশেষে রাত ১১টায় সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের কথা জানান আইন উপদেষ্টা।
এদিকে, উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি ভবন যমুনায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যা থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বাড়ানো হয়। প্রধান ফটকের ভেতরে সেনাবাহিনী, সামনে পুলিশ এবং পাশে র্যাব সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। সাদা পোশাকেও বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে টহল দিতে দেখা যায়। এদিন সচিবালয় এলাকায়ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রস্তুতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগেই নিয়ে রেখেছিল। গতকাল দুপুরে মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগকে দ্রুত নিষিদ্ধ করতে সন্ত্রাস দমন আইনের প্রয়োগ করা হতে পারে। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে এবং উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা পাওয়া মাত্রই তা বাস্তবায়ন করা হবে। একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জামায়াতকে যেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, একই আইন প্রয়োগ করে দ্রুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে এবং ওপরের সংকেত পেলেই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। তবে কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন বা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহারের ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছিল, কারণ দলটির গঠনতন্ত্র দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দেশব্যাপী আন্দোলনের সময় সহিংসতা উস্কে দেওয়ার অভিযোগে জামায়াতকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় নিষিদ্ধ করে। একই বছর জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ করা হয়। তবে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রমাণের অভাবে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।